আল্লাহর পরিচয় ও মানুষের অঙ্গিকার | The identity of Allah and the promise of man

আল্লাহর পরিচয় ও মানুষের অঙ্গিকার | The identity of Allah and the promise of man

আমরা সকলেই বলি যে,আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি। এর মানে কি?
তাই আমরা প্রথমেই আলোচনা করবো ‘আল্লাহ বিশ্বাস করা’-র অর্থ নিয়ে।
কুরআনুল কারীমের সূরা বাকারার ৮ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,

অর্থ: “মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা বলে যে, আমরা
আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি, (আমরা তাকে বিশ্বাস করি) কিয়ামতকে
বিশ্বাস করি; কিন্তু তারা মুমিন নয়।” (সূরা বাকারা, আয়াত ০৮)

এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা নিজেদেরকে ঈমানদ্বার দাবীকারী কিছু
লোকের ব্যাপারে বলছেন যে ওরা মুমিন নয়, ওরা মুনাফিক। পবিত্র
কুরআনে মহান আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের আলোচনা শুর“ই করেছেন
মূলত: এই আয়াত দিয়ে। এর আগে কুরআনুল কারীমের সূরা বাকারার
প্রথম পাঁচটি আয়াত হচ্ছে মুমিন সম্পর্কে।
তার পরের ২টি আয়াত
কাফিরদের সম্পর্কে। তার পরের ১৩ টি আয়াত নাযিল হয়েছে
মুনাফিকদের সম্পর্কে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে
মুনাফিক। কাফিরের চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে মুনাফিক।
কুরআনুল কারীমে কাফিরদের নামে একটি সূরা নাযিল হয়েছে কাফির“ন
যা মাত্র ৬ আয়াতের। একইভাবে মুনাফিকদের নামেও একটি সূরা নাযিল
হয়েছে মুনাফিকুন -যা প্রায় দেড় পৃষ্ঠা। যার আয়াত সংখ্যা ১১। সূতরাং
বুঝা গেলো যে মুনাফিকরা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ।
আমাদের বুঝতে হবে যে, আমরা আবার এই মুনাফিকদের দলে পরে যাই কি না?

এজন্যই আমরা আলোচনা টি শুর“ করবো ‘আল্লাহকে বিশ্বাস করা’ না করা
নিয়ে। প্রথমেই আসুন জেনে নেয়া যাক আল­াহকে বিশ্বাস করার অর্থ কি?
আল­াহকে বিশ্বাস করা সম্পর্কে আমরা কুরআন এবং হাদীস থেকে যতটুকু
ধারণা পাই তাতে দুটি বিষয় আসে।

১) আল্লাহকে বিশ্বাস করার অর্থ হলো আল্লাহর উযুদ বা আল্লাহ
আছেন এবং তার অস্তিত্বকে বিশ্বাস করা। সংক্ষেপে যাকে বলে
তাওহীদ।

২) আল্লাহর ওয়াহদানিয়াত বা এককত্ত্বে বিশ্বাস করা।
আল্লাহর এই এককত্ব তিনভাবে পাওয়া যায়।

১. উলূহিয়্যাত। ইবাদতের
ক্ষেত্রে তাওহীদ বা আল্লাহর এককত্ত্ব বজায় রাখা। ২. র“বুবিয়্যাত।
র“বুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে একত্ববাদকে বজায় রাখা। ৩. আল আসমা ও
সিফাত। আসমাউস সিফাতের ক্ষেত্রে একত্ববাদকে বজায় রাখা।
আমরা আজকে যেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি তা হচ্ছে উযুদে বারি
তাআলা বা আল্লাহর অস্তিত্ব। মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কালামে
মাজীদে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন,
অর্থ: “আমি জীন এবং মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদত
করার জন্য।” (সূরা যারিয়াত, আয়াত ৫৬)

এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন যে, তিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তার
ইবাদত, আনুগত্য, দাসত্য করার জন্য। এখন আমরা যারা মহান আল্লাহর
দাসত্ব করবো, তাকে তো আগে চিনতে হবে। না চিনে কিভাবে আল্লাহ
তাআলার ইবাদত করবো? কিভাবে তার গোলামী ও দাসত্য করবো?
এজন্য আল্লাহর পরিচয় লাভ করা এটা ঈমান আনার জন্য প্রথম শর্ত। কে
সে আমরা যার ইবাদত করবো?
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও এই বিষয়টিকে গুর“ত্ব দিয়েছেন। মানব
জাতিকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠাবার আগেই রূহ গুলোকে একত্রিত করে
এ উপলক্ষ্যে বিশাল এক সমাবেশ করলেন। যেখানে হযরত আদম আ.
থেকে শুর“ করে কিয়ামত পর্যন্ত যে মানুষেরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবে
সকলকেই সেই সমাবেশে অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য করেছেন। কুরআনুল
কারীমে সূরা আরাফের ১৭২-১৭৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন:

অর্থ: “আর স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন তোমার রব হযরত
আদম আ. এর পিঠের থেকে তার সন্তানদের র“হ গুলোকে বের
করলেন। আবার সেই সন্তানদের পিঠের থেকে তাদের সন্তানদের
এইভাবে সকলের র“হ গুলোকে বের করলেন। এরপর তাদের উপরে
তাদের নিজেদেরকে সাক্ষ্য বানালেন। এরপর তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে
বললেন, আমি কি তোমাদের রব নই? তখন সকলে সমস্বরে
ঘোষণা করলো, অবশ্যই অবশ্যই আপনি আমাদের রব এবং আমরা এর
সাক্ষ্য দিচ্ছি। (মহান আল্লাহ বললেন) আমি এটা এজন্য করেছিলাম যাতে
করে তোমরা কিয়ামতের দিন একথা বলতে না পারো যে, (আপনি যে
আমাদের রব) আমরা এসম্পর্কে জানতাম না, অজ্ঞ ছিলাম।” (সূরা
আরাফ :১৭২)

এই আয়াতে দ্বারা হযরত আদম আ. এর পিঠের থেকে এবং
তাদের পিঠের থেকে এমন করে ধারাবাহিকভাবে যত মানুষ জন্ম নিবে
সকলকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। তারপর আল্লাহ তাআলা সেই মহা
সমাবেশে তাদের সামনে নিজের পরিচয় দিলেন, তাদেরকে তাদের রব
আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা দিলেন এরপর তাদেরকে পরীক্ষা নিলেন এবং
তাদের নিজেদের ব্যাপারে নিজেদেরকে সাক্ষী বানালেন। এজন্য
তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি তোমাদের রব নই?
তখন তারা সকলে উত্তর দিয়েছিলো, সব লোকেরা বললো
অবশ্যই অবশ্যই আপনি আমাদের রব এবং আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি।
আরবীতে কোন কিছু স্বীকার করা, সাক্ষ্য দেয়া দু’টি শব্দ ব্যবহৃত হয়।
একটি হচ্ছে আর অপরটি হচ্ছে । এই দুটির মাঝে পার্থক্য
হচ্ছে। যখন কোন বিষয়কে প্রমাণ সহকারে ব্যক্ত করা হয় তখন বলা হয়
। তার মানে অবশ্যই আপনি আমাদের রব। কেনই বা আপনি
আমাদের রব হবেন না। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি। আল্লাহ তাআলা
বলছেন যে এই সাক্ষ্য আমি কেন নিলাম?
অর্থ: “যাতে করে কিয়ামতের দিন এটা বলতে না পারো যে আমরা তো এ
সম্পর্কে গাফেল ও অজ্ঞ ছিলাম। (আপনি যে আমাদের রব তা আমরা
জানতাম না।)” (সূরা আরাফ, আয়াত ১৭২)

অথবা যাতে তোমরা একথা বলতে না পারো,
অর্থ: “আমাদের পিতৃপুর“ষরা আগে শিরক করেছে। আমরা তো তাদের
পরবর্তী তাদের সন্তান ছিলাম তাদের অনুসরণ করেছি মাত্র। আপনি কি
আমাদেরকে আমাদের পূর্ববর্তী বাপ-দাদারা আগে যেই শিরক করেছে
সেই পূর্ববর্তী বাতিলদের অন্যায়ের কারণে শাস্তি দিবেন?” (সূরা
আরাফ, আয়াত ১৭৩)

এই অভিযোগ যাতে না করতে পারো সেজন্য
তোমাদের নিজেদেরকেই নিজেদের ব্যাপারে সাক্ষী বানালাম।
এই আয়াতের মাধ্যমে আরো একটি বিষয় পরিস্কার হয়, তা হলো পূর্ববর্তী
লোকেরা দলীল নয়। দলীল হবে কুরআন এবং সুন্নাহ। যে কোন ব্যাপারে
মতানৈত্য দেখা দিলে সে বিষয়ে মহান আল­াহ এবং তার রাসূলের দিকে
যেতে হবে। কুরআন এবং হাদীসের সমাধান মানতে হবে। যেমন অন্য
আয়াতে ইরশাদ হয়েছে:
অর্থঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল­াহর অনুসরণ করো এবং তোমাদের
মধ্যকার আল্লাহর রাসূলের অনুসরণ করো এবং উলিল আমরদের।
অতঃপর যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মাঝে বিরোধ দেখা দেয় তাহলে
তার ফায়সালা ও সমাধানের জন্য তোমরা আল্লাহ এবং তার রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম -এর দিকে প্রত্যাবর্তন কর। যদি তোমরা
আল্লাহ এবং শেষ দিবসে বিশ্বাসী হয়ে থাকো।” (সূরা নিসা, আয়াত ৫৯)

একইভাবে মহানবী সা. বিদায় হজ্জের ভাষণেও কয়েক স্থানে বার বার
বলেছেন,
অর্থ:- রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ “আমি তোমাদের মাঝে দু’টি
জিনিস রেখে গেলাম। তোমরা যতক্ষণ এগুলোকে আঁকড়ে ধরে থাকবে
ততক্ষণ তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব, আরেকটি
হলো তার নবীর সুন্নাহ্।”(মুআত্তা মালেক: ৩৩৩৮ তাকদীর অধ্যায়: ৩ নং
হাদিস যয়িফ সনদে)

অর্থ: “আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন: রাসুল (সাঃ) বলেছেন: আমি তোমাদের
মধ্যে এমন দুইটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যে, যদি তোমরা এর উপর আমল
কর তবে কখনো গোমরাহ হবে না। প্রথমত: আল্লাহর কিতাব। দ্বিতীয়:
আমার সুন্নাহ।” (মুসতারাকে হাকেম -৩১৯, হাকেম সহীহ সনদে, সহীহ
আল জামেউস সাগীর : ২৯৩৪)

এটা বর্তমানেও অনেক সময় হয়ে থাকে। যখন কোন বিতর্কিত বিষয়ে
কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সমাধান দেয়া হয় তখন অনেকে সেই কুরআন ও
সুন্নাহর সমাধান না নিয়ে বরং সে ব্যাপারে নিজেদের পূর্ববর্তীদেরকে কিংবা
কোন বড় আলেম, হুজুরকে দলীল হিসেবে সামনে নিয়ে আসেন। তারা
বলেন যে, আরে আপনারা কি বেশি বুঝেন। এতো বড় বড় আলেমগণ কি
বুঝেন নি? ইত্যাদি।

এজন্যই মহান আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে আসার আগেই আমাদের থেকে
এব্যাপারে অঙ্গীকার নিলেন। আমি কি তোমাদের রব নই?
তখন তারা সকলে উত্তর দিয়েছিলো, সব লোকেরা বললো
অবশ্যই অবশ্যই আপনি আমাদের রব এবং আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি এবং
বিষয়টি যথাযথভাবে পবিত্র কুরআনেও উলে­খ করে আমাদেরকে স্মরণ
করিয়ে দিয়েছেন।

এভাবে আল্লাহ তা’আলা রূহের জগতে মানুষদের থেকে সাক্ষ্য আদায়
করলেন। যাতে করে দুনিয়াতে আসার পরে আল্লাহর অস্তিত্বকে
অস্বীকার করতে না পারে। অত:পর আল­াহ তাআলা মানুষকে দুনিয়াতে
পাঠিয়ে দিলেন এবং দুনিয়াতে তাদের জন্য কিছু ইবাদত নির্ধারণ করে
দিলেন। তার মধ্যে সবচেয়ে গুর“ত্বপূর্ণ ইবাদতের নাম হচ্ছে সালাত বা
নামাজ। সেই সলাতের মধ্যে একটা সূরাকে নির্দিষ্ট করে দিলেন যা না
পড়লে নামাজ হবে না। সেই সূরার নাম কি? সেই সূরার নাম হচ্ছে সূরা
ফাতিহা। রাসূলুল­াহ সা. ইরশাদ করেন,

অর্থ: “হযরত উবাদা ইবনুস সামিত রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী সা.
বলেছেন, যেই ব্যক্তি তার নামাজে সূরায়ে ফাতিহা না পড়বে তার নামাজ
হবে না।” (সহীহ বুখারী, ৭২৩)

এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইমাম আবূ হানীফা রহ. বলেন যে, নামাজে
সূরায়ে ফাতেহা পড়া ওয়াজিব। যদি কেউ না পড়ে তাহলে নামাজ
দোহরাতে হবে। অন্য ইমামরা বলেছেন ফরজ সূরায়ে ফাতেহা না পড়লে
নামাজই হবে না। উদ্দেশ্য একই, তাহলো এই সূরার গুর“ত্ব বুঝানো।
আল্লাহর রাসূল সা. এই সূরার এতো গুর“ত্ব দিলেন কেন? কি রয়েছে এই
সূরার মধ্যে যা না পড়লে নামাজই হবে না?

এই সূরাকে বলা হয় উম্মুল কুরআন। তাফসীরের কিতাবে লিখে আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন হযরত আদম আ. থেকে হযরত মুহাম্মাদ সা. পর্যন্ত
রাসূলদের প্রতি যত কিতাব নাযিল করেছেন সমস্ত কিতাবের সার মর্ম
হচ্ছে আল কুরআনুল কারীম। আর কুরআনুল কারীমে যা কিছু রয়েছে তার
মূল হলো সূরায়ে ফাতিহা। আর সূরায়ে ফাতিহায় যা কিছু রয়েছে তার মূল
সার মর্ম হচ্ছে একটি আয়াত সেটি হলো
অর্থ: “আপনারই আমরা ইবাদাত করি, এবং আপনারই নিকট সাহায্য
চাই।” (সূরায়ে ফাতিহা, আয়াত ৪)

সূরায়ে ফাতিহা যেই আয়াত দ্বারা শুর“ বা তার প্রথম আয়াত
অর্থ: “সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি জগত সমূহের জাহানের
রব।” এই সূরায়ে রবের পরিচয় আছে। এই আয়াতটির মাঝেই আল্লাহ

তা’আলার পরিচয় রয়েছে। আবার যখন আমরা র“কুতে যাই তখন
তাসবীহ পড়ি, বলি-
অর্থ: “আমার মহান রবের পবিত্রতা ঘোষণা করছি।” এখানেও রবের
প্রশংসা করা হচ্ছে। আবার যখন আমরা র“কু হতে সোজা হয়ে দঁাড়াই
তখন পাঠ করি হে আমাদের প্রতিপালক, তোমার জন্যই
সকল প্রশংসা। এখানেও রবের প্রশংসা করা হচ্ছে। আবার যখন সিজদায়
যাই, তখন পাঠ করি অর্থ: আমার সুমহান রবের
পবিত্রতা ঘোষণা করছি।

এর অর্থ হচ্ছে, নামাজে দঁাড়ানো অবস্থায় রব, র“কু অবস্থায় রব, র“কু
থেকে দঁাড়িয়ে রব, সিজদায় গিয়ে রব। সব স্থানেই রবের আলোচনা
হচ্ছে। দুনিয়াতে আসার আগেও রবের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিলো।
দুনিয়াতেও সব জায়গাতেই রবের স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। দুনিয়া থেকে
যাওয়ার পরে আখেরাতের সফর শুর“ হবে। আখেরাতের সফরের প্রথম
ঘাটি হচ্ছে কবর। সেই কবরে তিনটি প্রশ্ন করা হবে। তার মধ্যে সর্ব প্রথম
প্রশ্ন হচ্ছে, তোমার রব কে? জীবনে তুমি কাকে রব হিসেবে
গ্রহণ করেছো? তোমার রব কি কোন শাসক, না ফিরআউন না নমর“দ না
হামান? নাকি কোন নেতা-নেত্রী। কোন জনক বা ঘোষক তোমার রব
ছিলো কি না?

যখন আমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে তোমার রব কে? তখন আমরা
কি জবাব দিবো? রবকেই তো চিনি না। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে রবের
অস্তিত্বের বিষয়টি জানা অত্যন্ত গুর“ত্বপূর্ণ বিষয়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়াতে পাঠানোর আগে পরীক্ষা নিলেন,আমি কি তোমাদের রব নই?
এরপর দুনিয়াতে আসার পরে সবচেয়ে গুর“ত্বপূর্ণ ইবাদত সালাতের মধ্যে
দঁাড়ানো অবস্থায়, র“কু অবস্থায়, সিজদা অবস্থায় সব জায়গাতেই রবের
আলোচনা করা হচ্ছে। আখেরাতের প্রথম ঘাটি কবরেও প্রথম প্রশ্ন করা
হবে রব সম্পর্কে। সুতরাং রব সংক্রান্ত বিষয়টি অত্যন্ত গুর“ত্বপূর্ণ কি
না? এই রবের পরিচয় নিয়েই আজকে আমাদের আলোচনা হচ্ছে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রবের পরিচয় কুরআন শরীফে উলে­খ করে
দিয়েছেন। সূরা ত্বহা এর ৫০ নং আয়াতে। এই সূরায় ফিরআউনের কাছে
হযরত মূসা আ. এর দীনের দাওয়াত দেয়ার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।
মহান আল­াহ হযরত মূসা আ. এবং হার“ণ আ. কে বললেন,
অর্থ: “তোমরা যাও (যেই ফিরআউন নিজেই নিজেকে রব বলে দাবী
করেছে সেই) ফিরআউনের কাছে, গিয়ে তাকে আমি রবের দাওয়াত
দাও।” (সূরা ত্বহা, আয়াত ৪৩)

হযরত মূসা আ. যখন ফিরআউনের কাছে গিয়ে তাকে রবের দাওয়াত
দিলেন তখন ফিরআউন হযরত মূসা আ. কে জিজ্ঞেস করলো,
অর্থ: “হে মূসা কে তোমার রব? (কি তার পরিচয়?)” (সূরা ত্বহা, আয়াত
৪৯)

কারণ রবের একটা অর্থ যে, প্রতিপালক, লালন-পালন করা সেটা
ফিরআউনও বুঝতো। তো হযরত মূসা আ. যেহেতু ফিরআউনের ঘরেই
লালিত-পালিত হয়েছিলেন তাই ফিরআউন জানতে চাইলো সে ছাড়া আর
কে আছে রব। অর্থাৎ ফিরআউন এটাই বলতে চাচ্ছিলো যে, তোমার রব
তো আমিই। তুমি অন্য কোন রবের দাওয়াত দিচ্ছো?
মহান আল্লাহ হযরত মূসা আ. কে ফিরআউনকে বুঝানোর জন্য রবের যেই
সংজ্ঞা শিখিয়েছিলেন, আমাদেরকে বুঝাবার জন্য সেটিই জানিয়ে
দিয়েছেন। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে:
অর্থ: “হযরত মূসা আ. বললেন, আমার রব হচ্ছেন তিনি, যিনি সকল
মাখলুকাতকে সৃষ্টি করেছেন এরপর সৃষ্টি থেকে পূর্ণতায় পেঁৗছানো পর্যন্ত
প্রয়োজনীয় সকল কিছুর যিনি ব্যবস্থা করে দেন।” (সূরা ত্বহা : ৫০)

অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তুর জীবন-যাপনের পদ্ধতি যিনি শিক্ষাদান করেছেন,
জীবনের পদে পদে যা যা তাদের লাগবে তার সব যিনি পূরণ করেন,
ব্যবস্থা করেন তিনিই হচ্ছেন রব।
এর উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি, মানুষ যখন তার মায়ের পেটে
আসে তখন মহান আল­াহ কিভাবে এক ফেঁাটা পানি থেকে তাকে বিভিন্ন
প্রক্রিয়ায় সুন্দর করে তৈরী করেন। এ সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে,
অর্থ: “তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির ন্যায় শুষ্ক ঠনঠনে মৃত্তিকা
থেকে।” (সূরা আর রাহমান : ১৪) অন্যত্র আরো ইরশাদ হয়েছে,

অর্থ: “আর অবশ্যই আমি মানুষকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি।
তারপর আমি তাকে শুক্ররূপে সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। তারপর
শুক্রকে আমি ‘আলাকায় পরিণত করি। তারপর ‘আলাকাকে গোশ্তপিÊে
পরিণত করি। তারপর গোস্তপিন্ডকে হাড়ে পরিণত করি। তারপর
হাড়কে গোশ্ত দিয়ে আবৃত করি। অতঃপর তাকে অন্য এক সৃষ্টিরূপে
গড়ে তুলি। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত বরকতময়! এরপর
অবশ্যই তোমরা মরবে। তারপর কিয়ামতের দিন অবশ্যই তোমরা
পুনর“ত্থিত হবে।” (সূরা মু’মিনুন : ১২-১৬) আরো ইরশাদ হয়েছে,

অর্থ: “তিনিই তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর শুক্রবিন্দু
থেকে, তারপর ‘আলাকা’ থেকে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে শিশুরূপে
বের করে আনেন। তারপর যেন তোমরা তোমাদের যৌবনে পদার্পণ কর,
অতঃপর যেন তোমরা বৃদ্ধ হয়ে যাও। আর তোমাদের কেউ কেউ এর
পূর্বেই মারা যায়। আর যাতে তোমরা নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে যাও। আর
যাতে তোমরা অনুধাবন কর।” (সূরা গাফির : ৬৭)

এভাবে মানুষ মায়ের পেটে তৈরী হলো, পাঁচ মাস সময় চলে গেছে। বডি
তৈরী হয়েছে। রূহ চলে এসেছে। ক্ষুধা লেগে গেছে। এবার মায়ের পেটে
ক্ষুধা লাগলে খাওয়াবে কে? বাচ্চার খাবারের ব্যবস্থা করবে কে? এটি তো
এমন এক স্থান যেখানে কোনো আন্দোলন করার সুযোগ নেই। এমনকি
বাচ্চার জন্য কান্না-কাটি করাও সম্ভব নয়। সেখানে কে খাবার দিবে?
আল­াহু আকবার! দেখুন, যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই খাবারের ব্যবস্থা
করছেন। আল­াহ রাব্বুল আলামীন নিজের থেকে বুঝে শুনে মায়ের মাসিক
ঋতুস্রাব বন্ধ করে দিয়ে শিশুর নাভির সাথে মায়ের নাভি সংযুক্ত করে দিয়ে
বাচ্চার খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। যাতে করে বাচ্চার কান্না-কাটি না
করতে হয়। যেন বাচ্চার কষ্ট না হয়। যিনি এমনটি করেছেন তিনিই
হলেন রব। সুবহানাল্লাহ। ইরশাদ হচ্ছে:

অর্থ: “হযরত মূসা আ. বললেন, আমার রব হচ্ছেন তিনি, যিনি সকল
মাখলুকাতকে সৃষ্টি করেছেন এরপর সৃষ্টি থেকে পূর্ণতায় পেঁৗছানো পর্যন্ত
প্রয়োজনীয় সকল কিছুর যিনি ব্যবস্থা করে দেন।” (সূরা ত্বহা : ৫০)

এখানে রবের আলোচনা থেকে শুর“ করা হয়েছে। কারণ রব থেকে
উলুহিয়্যাতের আলোচনা আসবে। আল্লাহ তাআলা এখানে বুঝিয়ে দিলেন
যে, তিনিই হচ্ছেন রব। এবার মায়ের পেটে থেকে সন্তান ধীরে ধীরে বড়
হলো। সন্তানের বয়স বাড়লো ৯ মাস পূর্ণ হলো ১০ দিন পেরিয়ে
গেলো। এবার সে দুনিয়াতে আসলো। এখন তার খাবারের প্রয়োজন।

দুনিয়াতে এসেই তো শিশু বাচ্চা মানুষের তৈরী খাবার খেতে পারবে না।
ঠান্ডা হলে সর্দি লাগবে। গরম হলে মুখ পুড়ে যাবে। শক্ত হলে গলায়
আটকে যাবে। তার শরীর এখন দূর্বল। খুবই দূর্বল। বিভিন্ন রোগ-জীবানু
এসে তাকে আক্রমণ করবে। তাই তার জন্য চাই শক্তিবর্ধনকারী, রোগ
প্রতিরোধকারী এবং সুষম খাবার। এমন খাবার যা কোন মানুষ তৈরী করে
দিতে পারবে না। কে ব্যবস্থা করবে সন্তানের জন্য অপরিহার্য্য
প্রয়োজনীয় এমন খাবারের? এবারও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন
নিজের থেকে বুঝে শুনে শিশুর জন্য তার মায়ের বুকের মাঝে এমন এক
দুধ তৈরী করলেন যার বিকল্প আজ পর্যন্ত কেউ করে দেখাতে পারেনি।
মায়ের দুধের মধ্যে প্রথম যেই শালদুধ বের হয় তা অন্য দুধ থেকে একটু
গাঢ় হয়। হলুদ বা হালকা হলুদ রঙের। ঘন দুধ। আগে গ্রামের অশিক্ষিত
মেয়েরা বলতো যে, এই শালদুধ ফেলে দিতে হবে। কারণ এটি খেলে

নাকি ধনুষ্টংকার রোগ হবে। আল্লাহ কি এই দুধ ফেলে দেয়ার জন্য বা
ধনুষ্টংকার হওয়ার জন্য সৃষ্টি করেছেন? কখনো নয়। বিজ্ঞান আবিস্কার
করেছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তাররা আবিষ্কার করেছেন যে,
জন্মগ্রহণের পর শিশুর জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য্য পানাহার হচ্ছে মায়ের
শালদুধ। তাই আজকাল যে কোন হাসপাতালে দেখবেন লেখা রয়েছে,
জন্মের পরই শিশুকে মায়ের শালদুধ খাওয়ান। কেননা, এই দুধের মাঝে
একদিকে খাবার আছে, অপর দিকে রয়েছে পানীয় সমানভাবে এতে আছে
রোগ প্রতিরোধকারী ঔষধও। এভাবে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন
মায়ের বুকের দুধের মাঝে সন্তানের জন্য খাবার, পানীয় এবং ঔষধ
তৈরী করে তাকে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করেছেন। এর নামই হলো রব।

এবার বাচ্চা দুধ পান করে করে বড় হচ্ছে। প্রায় ২ বছর বয়স হয়ে
গেলো। এবার তার খিচুরী খেতে হবে। মুরগীর বাচ্চা খেতে হবে। এবার
মহান আল্লাহ সেই বাচ্চার মুখে দাঁত গজিয়ে দিলেন। বাচ্চা সেই দাঁত
দিয়ে খিচুরী খেতে লাগলো। মুরগী-কবুতরের বাচ্চা খেতে লাগলো।
খেতে খেতে বড় হতে লাগলো। এভাবে বড় হতে হতে তার বয়স ৭/৮
বছর হয়ে গেলো। এবার শুধু বাচ্চা মুরগীতেই কাজ হবে না। তার গর“র
গোশত, খাসীর গোশত এবং হাড্ডি চাবাতে হবে। তাই মহান আল্লাহ
এবার তার মুখের সেই কচি দাঁত গুলো ফেলে দিয়ে ধীরে ধীরে সেখানে
শক্ত ও কোনাচে কোনাচে দাঁত গজিয়ে দিলেন। মুখটাও একটু একটু করে
বড় হতে লাগলো। দাঁতের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। কি সুন্দর ব্যবস্থা।
এক সাথে নয়। ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন হতে লাগলো। সুবহানাল্লাহ। -
ইনিই হলেন সেই রব। যিনি কোন দরখাস্ত বা আবেদন ছাড়াই নিজের
পক্ষ থেকে বুঝে শুনে এই সকল ব্যবস্থা করছেন তিনিই হলেন সেই
মহিমান্বিত রব।

অর্থ: “(তিনিই আমার রব) যিনি আমাকে খাবার ও পানীয় সরবরাহ
করেন, যখন আমি অসুস্থ্য হই তখন তিনি আমাকে সুস্থ্য করেন।” (সূরা
শুআরা : ৭৯-৮০) এজন্যই মহান আল্লাহ অন্যত্র বলছেন,
অর্থ: “আর তোমাদের মধ্যেও (ভালোভাবে লক্ষ্য করো) আমার পরিচয়
পেয়ে যাবে। এরপরও কি তোমরা অনুধাবন করবে না?” (যারিয়াত : ২১)
অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও তো একটি প্রাণী। মানুষের আলোচনা বাদ
থাকবে কেন, আল্লাহ বলছেন তোমরা আমাকে চেনার জন্য এবার তোমরা
তোমাদের নিজেদের মধ্যে লক্ষ্য করো, আমার পরিচয় পেয়ে যাবে। এই
পৃথিবীতে মহান আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, আগুন, মাটি, মর“ভূমি,
সাগর, পানি, বাতাস তার সবই এই মানুষের মধ্যে নমুনা রেখেছেন।

বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন মানুষের রক্তের মাঝে অনেক ব্যাকটেরিয়া
চলাচল করে। মানুষের মুখের মধ্যে ২০০ প্রজাতির জীবানু বাস করে।
সাধারণ ঝড় তুফানের গতি ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়।
২০০ কিলোমিটার গতির ঝর হলে মানুষ পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যায়।
বিজ্ঞান গবেষণা করে দেখেছে মানুষের নাকের ভেতর যে পশমের নেট
আছে তা ভেদ করে যখন ভেতরে ধুলো-বালি প্রবেশ করে তখন নাকের
পানি দিয়ে তা বের করা হয়। এরপরও যদি কিছু ভেতরে থাকে তাহলে
যখন হাঁচি আসে। হাঁচির গতিবেগ হলো ২০০ কিলোমিটার। এই গতির
মাধ্যমে ভেতরের সকল ধুলো-কণা ও রোগ-জীবানু বের করে দেয়া হয়।
সুবহানাল্লাহ।

এবার মহান আল­াহ বলছেন, হে মানুষ তোমরা এবার চিন্তা করে দেখো
তোমার নিজের ভেতরকার এই মিনি পৃথিবী চালাবার মতো অন্য কেউ
আছে কি না। দুনিয়ার সকল জ্ঞানী-বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে একমত যে, এই
ছো“ পৃথিবীটাকে পরিচালনা করার জন্য একটি শক্তি কাজ করছে। যেটা
থাকলে মানুষ কথা বলতে পারে, না থাকলে মানুষ মৃত লাশ হয়ে যায়।
যেটা থাকলে সন্তান বাবা ডাকে, স্ত্রী স্বামী ডাকে, পাড়া-প্রতিবেশী সম্মান
করে। ওটা না থাকলে সবাই বলে একে তাড়াতাড়ি দাফন করে দাও।
সবাই বুঝে একটা শক্তি আছে। যাকে আরবীতে বলে রূহ। বাংলায় বলে
প্রাণ। এজন্য রূহ বিষয়ে মানুষের কৌতুহল ছিলো আগে থেকেই। এমনকি
আল­াহর রাসূল সা. কে পর্যন্ত কাফিররা জিজ্ঞাসা করেছিলো এ সম্পর্কে।
সূরায়ে ইসরা’র মধ্যে আছে। ইরশাদ হচ্ছে:


অর্থ: “হে নবী! তারা আপনার কাছে জানতে চায় রূহ সম্পর্কে, আপনি
বলে দিন রূহ হচ্ছে আমার রবের একটি আদেশমাত্র। (এর বেশি আর কি
বোঝাবো তোমাদের) এব্যাপারে তোমাদেরকে খুব কমই জ্ঞান দেয়া
হয়েছে।” (সূরা ইসরা, আয়াত ৮৫)

এটি এমন এক বিষয় যা বুঝানোর জন্য একটি উপমা দেয়া যায়। যেমন
কূয়ার ব্যাঙ সাগরের ব্যাংঙ এর কাছে জিজ্ঞাসা করছে, তোমার সাগরে
পানি কতটুকু? সাগরের ব্যাং চুপ করে বসে আছে। চিন্তা করছে এই
কূয়ার ব্যাংকে সে কিভাবে সাগরের পানি সম্পর্কে ধারণা দিবে। এরপর
আবারো কূয়ার ব্যাং একটি লাফ দিয়ে বললো তোমার সাগরের পানি কি
আমার এই কূয়ার পানির অর্ধেক হবে। সাগরের ব্যাং বললো, হ্যা হবে।
অর্থাৎ কূয়ার ব্যাংকে একটি প্রবোধ দিলো মাত্র।

মহান আল্লাহ তা’আলাও একইভাবে কাফিরদেরকে লক্ষ্য করে ঘোষণা
করলেন, আরে তোমরা রূহ সম্পর্কে জানতে চাও, অথচ তার সম্পর্কে
ধারণা পাওয়ার জন্য যেই সক্ষমতা থাকা দরকার তার কিছুই তো
তোমাদের নেই। তোমরা কেবল এতোটুকুই বুঝে নাও যে সেটি আমার
একটি আদেশ।

সত্যিই তো, আল­াহর আদেশ যতক্ষণ পর্যন্ত থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত কাজ
করে। আদেশ শেষ কাজও শেষ হয়ে যায়। আল্লাহ বুঝাতে চাচ্ছেন, হে
মানব, তোমার এই ছো“ পৃথিবীকে পরিচালনা করতে যদি একটি শক্তি
প্রয়োজন হয় -যা তোমরা সকলেই মানো। তাহলে তোমরা এখান থেকেই
বুঝে নাও যে, এই বিশাল বিশ্ব, আকাশ-নক্ষত্র, চন্দ্র-সূর্য, সাগর-নদী এই
সব গুলোকেও পরিচালনা করার জন্য একজন আছেন, তিনিই হচ্ছেন রব। 

অর্থ: “সকল প্রশংসা সারা জাহানের সেই রবের জন্যই।” সূরায়ে
ফাতিহা।
এখন প্রশ্ন হতে পারে আল্লাহ বা এই রব কয়জন? এই প্রশ্নের উত্তর
পাওয়ার জন্য হে মানুষ, তুমি তোমার নিজের মাঝেই চিন্তা করো। সকল
বিজ্ঞানী, মহা বিজ্ঞানীদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করো তোমার এই ছো“ পৃথিবী
নিয়ন্ত্রণ করার যদি একের অধিক শক্তি থাকে তাহলে অবস্থা কেমন হবে?
সকল জ্ঞানী-বিজ্ঞানী বলে যে, মানুষের রূহ একটিই। যদি একাধিক রূহ
থাকতো তাহলে সর্বনাশ হয়ে যেতো। একটি রূহ বলতো আজকে ঠান্ডা
প্রয়োজন। আরেকটি রূহ বলতো গরম দরকার। এই দুই রূহের সংঘর্ষে
দেহটাই ধ্বংস হয়ে যেতো। একইভাবে বিষয়টি সমগ্র বিশ্ব নিয়ে ভেবে
দেখো। যদি এই পুরো বিশ্ব জাহানে এক রবের অধিক কোন নিয়ন্ত্রক ও
ইলাহ থাকে তাহলে কি হবে?
অর্থ: “যদি এই জগতে এক আল­াহ ছাড়া আরো কোন ইলাহ থাকতো,
তবে এটি ধ্বংস হয়ে যেতো।” (সূরায়ে আম্বিয়া, আয়াত ২২)।

যদি বলেন যে, আল্লাহর রং ও কালার কি? দৈর্ঘ্য প্রস্থ কি? আল্লাহ বলেন,
তুমি তোমার মাঝে গবেষণা করো। তোমার দেহটা পরিচালনার জন্য যেই
রূহ টা রয়েছে, তার দৈর্ঘ্য কি? প্রস্থ কি? তার ভেদ কি? কালার কি? বলা
যাবে কিছু? মহান আল্লাহ তার সম্পর্কে এতোটুকু বলেছেন,
অর্থ: “আল্লাহ তা’আলা আরশে সমাসীন।” (সূরায়ে ত্বহা, আয়াত ৫)।
অর্থ: “আল্লাহ তা’আলা সকল কিছুকে তার ইলম দ্বারা বেষ্টন করে
রেখেছেন।” (সূরায়ে তালাক, আয়াত ১২)।

এখন আল­াহ কিভাবে আরশে আছেন, সেটি আমাদের জানা নেই। এজন্য
বলেছেন তোমার রূহ নিয়ে চিন্তা করো। তোমার ভেতরে তোমার রূহ
আছে এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এব অবস্থান সম্পর্কে যদি চিন্তা করো তবে তুমি
তোমার রব সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যাবে। তার পরিচয় পেয়ে যাবে। রূহের
কোন কালার নেই। রূহের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আমরা জানি না। যদি শরীরের
কোথাও একটি পিঁপড়া কামড় দেয় বা কোন অংঙ্গে আঘাত পাওয়া যায়
তাহলে যেখানেই সমস্যা হোক না কেন রূহের মাধ্যমে আমরা বুঝে ফেলি
যে, কোথায় ব্যাথা। একইভাবে মহান আল্লাহও সেই আটলান্টিক 
মহাসাগড়ের নীচেও যদি কোন পিপিলিকা চলে তাহলে তিনি সেটিও
দেখতে পান এবং তার সম্পর্কেও খবর রাখেন।

সুতরাং আমাদের এই দেহটি যে পরিচালনা করে সেই রূহ সম্পর্কেই যদি
আমরা কিছু জানতে না পারি তাহলে কিভাবে সকল জগতের রব সেই
মহান আল্লাহর অবস্থান ও দৈর্ঘ্য, প্রস্থ সম্পর্কে কি বুঝবো?
মহান আল্লাহর জ্ঞানের বিশালতা সম্পর্কে অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে,
অর্থ: “তিনিই সেই মহান আল্লাহ, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি
চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। তার কখনো তন্দ্রা বা নিদ্রা কিছুই আসে না।
আসমান এবং জমীনের সকল কর্তৃত্ব কেবলমাত্র তারই জন্য নির্দিষ্ট। কে
এমন আছে, যে তার অনুমতি ব্যতীত তার কাছে সুপারিশ করবে? কিন্তু
তিনি যাকে অনুমতি দিবেন তার কথা ভিন্ন। তিনি তার সামনে পিছনের
সকল বিষয়ে সমানভাবে অবগত। তার জ্ঞানের বিশালতাকে কোন কিছুই
স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু তিনি যা চান তা ব্যতীত। তার কুরসী
আসমান এবং যমীনে বিস্তৃত এবং তিনি কখনো ক্লান্ত হননা। তিনিই
শ্রেষ্ঠ, সুমহান।” (সূরায়ে বাকারা, আয়াত ২৫৫)।

এজন্যই যারা মহান আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করেন, যেই সকল বিজ্ঞানী
মহা-বিজ্ঞানী গবেষণা করেন তারা মহান আল­াহর সামনে নত হয়ে
আসেন। আল্লাহর অস্তিত্ব তারা অনুভব করেন এবং এক সময় ঈমান
আনেন। যারা মহান আল­াহর এই সকল সৃষ্টির পরিচালনা নিয়ে চিন্তা
করেন তারা বুঝেন যে এগুলো কোন একজন পরিচালক ছাড়া চলতে পারে
না, আর সেই পরিচালকই হচ্ছেন মহান রব বা আল্লাহ। তাই তারা
আল্লাহর পরিচয় পেয়ে যান।

ইমাম আবূ হানীফা রা. এর সময়ের একটি ঘটনা। সেই সময়কার খলীফার
দরবারে একবার একজন উচ্চ শিক্ষিত নাস্তিক এসে বললো, আল্লাহ বলে কিছু নেই। যদি প্রমাণ করতে পারো তাহলে আমি মানবো। তোমাদের
মধ্যে কে জ্ঞানী আছে তাকে ডাকো। খলীফার অনুরোধ করলেন হযরত
ইমাম আবূ হানীফা রহ. কে সেই নাস্তিকের সাথে আলোচনা করার
জন্য। সময় দেয়া হলে ধরেন বিকাল ৩ টা। ইমাম সাহেব আসলেন
অনেক পরে। একেবারে ৫ টা বাজে। নাস্তিক এর মধ্যে খুশি হয়ে গেলো
যে, ইমাম আবূ হানীফা ভয় পেয়েছেন। তিনি পরাজিত হবেন বলে দেরি
করছেন। এরপর যখন ইমাম আবূ হানীফা রহ. আসলেন তখন সেই
নাস্তিক তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, ইমাম সাহেব আপনি এতো দেরি
করলেন কেন? আপনার না ৩ টা বাজে আসার কথা?

তখন জবাবে আবূ হানীফা রহ. বললেন, দেখো আমার বাড়ি দজলা নদীর
ঐ পাড়ে। আর আলোচনার এই স্থান হলো এই পাড়ে। আসতে হলে নদী
পার হওয়ার জন্য নৌকার প্রয়োজন। আমি নদীর পাড়ে এসে দেখলাম
সেখানে নদী পাড়াপাড়ের মতো কোন ব্যবস্থা নেই। কোন নৌকা নেই।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। অনেকক্ষণ পরে দেখলাম নদীর ভেতর
থেকে বিশাল এক গাছ বের হয়ে আসলো। কি আশ্চর্য যে, গাছটি আস্তে
তক্তা হয়ে গেলো। এরপর তক্তা গুলো একটি আরেকটির সাথে লেগে
যাচ্ছে। এরপর দেখলাম পেরেক চলে এলো। সেই পেরেক গুলো তক্তার
গায়ে লেগে গেলো। এরপর একটি নৌকা হয়ে গেলো। সেই নৌকাটি
এসে নদীর পারে আমার কাছে ভিড়লো। আমি তাতে উঠে এখানে
আসলাম। এই জন্য আমার দেরি হয়ে গেছে।

নাস্তিক এই ঘটনা শুনে বললো, আরে আমি তো শুনেছিলাম আপনি নাকি
বড় একজন জ্ঞানী। তাই আপনার সাথে আলোচনা করতে এসেছিলাম।
এখন তো দেখছি আপনি একজন মহা বোকা। আপনার সাথে কি কথা
বলবো। এটা কিভাবে সম্ভব যে, যে নদীর মাঝ থেকে গাছ এসে তক্তা হয়ে
পেরেক লেগে নৌকা হয়ে গেলো। এটা অসম্ভব।

এবার ইমাম আবূ হানীফা রহ. বললেন, আরে বোকা আমি না, বোকা হলে
তুমি। তোমার সাথে আমার আলোচনা শেষ হয়ে গেছে। তুমি যেহেতু
বস্তুবাদী তাই আমি তোমার সাথে কুরআন-হাদীস নিয়ে আলোচনা করবো
না, বস্তু দিয়েই তোমাকে জবাব দিবো। তুমি এতোই বোকা যে একটি
নৌকা এমনি এমনি তৈরী হওয়াকে তুমি মানতে পারো না, তার একজন
স্রষ্ঠা খেঁাজো। অথচ তোমার মতো এমন সুন্দর একটি মানুষ, যার নাক
আছে, কান আছে, চোখ আছে এবং সব গুলো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তার আপন
আপন স্থানে খুবই সুন্দরভাবে ফিট করা হয়েছে এটি কিভাবে একজন স্রষ্টা
ব্যতীত এমনি এমনি হতে পারে তা তুমি চিন্তা করলে না? তোমার জন্য
চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সব কিছু কে সৃষ্টি করে দিলেন তা নিয়ে তুমি গবেষণা
করে আল­াহর পরিচয় পেলে না তোমার চেয়ে বোকা আর কে আছে?
এবার নাস্তিক তার ভুল বুঝতে পারলো। আমাদেরও বুঝতে হবে যে,
এই সকল সৃষ্টির মাঝেই মহান আল­াহর পরিচয় লুকিয়ে আছে। আমি
আপনি মহান আল­াহর যে কোনো সৃষ্টির দিকে তাকালেই তার পরিচয়
পেতে পারি। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।

Previous
Next Post »